বিড়ালদের নাস্তা করানো আমাদের খুবই সাধারণ একটি ইচ্ছা, কিন্তু নাস্তা করানোর সময় এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোন খাবারগুলো আপনার বিড়ালের জন্য বিষাক্ত। কেননা মানুষদের অনেক জনপ্রিয় খাবারই আমাদের বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর খাবার।
বিড়ালরা হলো পরিবারের আনন্দায়ক সদস্য, যেহুতু প্রায়ই তাদের সাথে খাবারসহ সবকিছু ভাগাভাগি করতেই আমাদের খুব ভালো লাগে। কিন্তু খাবারের বেলায় আপনার খাদ্যতালিকায় সাধারণত যে খাবারটি থাকে সেটি তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। তাই তাকে নাস্তা পরিবেশনের আগে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে কোন খাবারটি আপনার বিড়ালের জন্য বিষাক্ত এবং কোনটি তার জন্য নিরাপদ।
আপনার কি উচিত মানুষের খাবার বিড়ালকে খাওয়ানো?
এটা জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্ষুধার্ত বিড়ালের বারবার মিও মিও ডাকের সত্ত্বেও মানুষের উপযোগী খাবারগুলো কখনোই তাকে খাওয়ানো ঠিক নয়। কেননা বিড়ালদের সুস্বাস্থ্যের জন্য কী কী খাদ্যের প্রয়োজন তা জানতে একবার আমরা কলম্বিয়ায় মিশৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র প্রাণী পুষ্টিসেবা অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমরা জানতে পারি, সচরাচর বিড়ালদের খেতে দেওয়া আমাদের খাবারগুলো তাদের জন্য যতটা নিরাপদ বলে মনে হয়, আসলে ঠিক ততটা নয়।
পুষ্টিসেবা অধিদপ্তরের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, বিড়ালদের পুষ্টিঘাটতি মেটাতে তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির একটি খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাওয়ানো দরকার। আর সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী যে উপায়ে আমরা এটা করতে পারি তা হলো যদি প্রাণীপুষ্টি বিদ্যায় পিএইচডি অর্জনধারী একদল বিশেষজ্ঞের নির্ধারিত খাদ্যতালিকা অনুযায়ী আমরা বিড়ালদের খাওয়াতে পারি।
সাধারণত আমরা মনে করি, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ আমাদের খাদ্যতালিকায় রাখা খাবারগুলো বিশেষ করে সকল প্রকার ফলমূল ও শাকসবজি বুঝি বিড়ালদের জন্যও উপযুক্ত। কিন্তু একজন প্রাণী পুষ্টিবিদের মতে কখনোই সব খাবার বিড়ালদের জন্য উপযুক্ত নয়। এমনকি অনেক সময় তাই এই খাবারগুলো তাদের জন্য অনেক ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে।
মানুষদের কোন খাবারগুলো আপনার বিড়ালের জন্য নিরাপদ?
সবকিছু জানার পরও আপনি যদি মানুষদের খাবারগুলো বিড়ালকে খাওয়াতে চান, তাহলে প্রাণী পুষ্টিসবা অধিদপ্তরের মতে, মানুষদের অনেক খাবারই তাদের জন্য নিরাপদ যতক্ষণ না তারা দৈনিক খাদ্য চাহিদার ১০ শতাংশ অস্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎস হতে গ্রহণ করছে। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, যদি আপনার বিড়ালটি দৈনিক ২৫০ ক্যালরি নেয়, তাহলে সেই ২৫০ ক্যালরির ২৫ ক্যালরিও যেন অস্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎস হতে না আসে।
যাইহোক, প্রাণী পুষ্টিসবা অধিদপ্তর সবসময় এটা সতর্ক করে যে বিড়ালদের অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায় খাওয়ানো উচিত। কেননা বিড়াল শ্রেণির কিছু বিড়াল যখন একটি নির্দিষ্ট খাবার স্বাচ্ছন্দ্যে হজম করতে পারে, তখন ঠিক একই খাবার অন্য বিড়াল খেলে বমি, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আরো শরীরিক সমস্যায় পড়তে পারে। তাই সব সময় এটা আপনার মাথায় রাখতে হবে যে, আপনার বিড়ালের খাদ্যতালিকায় মানুষদের কোনো নতুন খাবার যোগ করার পূর্বে অবশ্যই আপনার উচিত প্রাণী পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন খাবার যোগ করা। আর এটি করলে আপনার বিড়ালের জন্য অনেক ভালো হয়।
মানুষের কোন খাবারগুলো বিড়ালদের জন্য বিষাক্ত?
প্রাণী পুষ্টিসবা অধিদপ্তরের মতে, ‘মানুষের খাদ্যতালিকার কিছু খাবার আছে যা বিড়ালদের জন্য বিপজ্জনক এবং এগুলো কখনই আপনার বিড়ালকে খাওয়ানো উচিত নয়। বিড়ালদের খাওয়ানোর উপযোগী একটি দীর্ঘ তালিকা ASPCA(একটি প্রতিষ্ঠান) এর কাছে রয়েছে, যেটি মূলত বিভিন্ন পুষ্টিবিদের পরামর্শে ও অন্যান্য অনেক গবেষণার মধ্য দিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
নিচে ASPCA এর তালিকায় রাখা মানুষদের কয়েকটি খাবারের কথা উল্লেখ করা হলো যা বিড়ালদের এড়ানো উচিত:
১. অ্যালকোহল: বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর খাবার
যেকোনো অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় আপনার প্রিয় বিড়ালের জন্য সৃষ্টি করতে পারে জটিল সমস্যা। অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় খেলে হতে পারে বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, কোমা এবং এমনকি মৃত্যু।
২. ইয়েস্টযুক্ত রুটি বা ময়দা:
ইয়েস্টযুক্ত যেকোনো রুটি বা ময়দা আপনার বিড়ালের পরিপকিতন্ত্রে তৈরি করতে পারে গ্যাসের সমস্যা। এর ফলে পেট ফাঁপাসহ বিড়ালের তলপেটে মোচড় দিতে পারে নিয়ে, যেটি তার জন্য হয়ে উঠতে একটি মারাত্মক অবস্থা। এছাড়া ইয়েস্টযুক্ত রুটি বা ময়দায় উপজাত হিসাবে অ্যালকোহল তৈরি হয়, যেটি দ্বারা আরো কয়েকটি সমস্যার তৈরি করতে পারে।
৩. চকলেট:
চকলেটে সাধারণত মিথাইলক্সান্থাইনস (বিশেষত থিওব্রোমিন ও ক্যাফিন) নামক রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা বিড়ালদের জন্য বিষাক্ত। তাই চকলেট খেলে বিড়ালের হতে পারে বমি, ডায়রিয়া, কাঁপুনি, খিঁচুনি ও এমনকি মৃত্যু। বিভিন্ন ধরনের চকলেটের মধ্যে মিথাইলক্সান্থাইনের মাত্রার তারতম্য থাকে। যেমন- কোকো পাউডারযুক্ত চকলেট সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক আর সাদা চকোলেটগুলো তেমন একটা বিপজ্জনক নয়।
৪. কফি:
চকলেটের মত কফিতে মিথাইলক্সানথাইন ক্যাফিন থাকে যা চকলেটের মতোই এইরকম প্রভাব ফেলতে পারে।
৫. সাইট্রিক এসিডযুক্ত ফল:
লেবু, চুন, কমলা, ক্লেমেন্টাইন এবং আঙ্গুরের মতো সাইট্রিক অ্যাসিডযুক্ত ফলগুলি আপনার বিড়ালের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এইসব সাইট্রিক এসিডযুক্ত ফলের ডালপালা, পাতা, খোসা, ফল এবং বীজ বিড়ালের থেকে দূরে রাখতে হবে। এইসব সাইট্রিক এসিডযুক্ত ফলের একটুও খেলে আপনার বিড়ালের হতে পারে পেট খারাপ, ডায়রিয়া, বমি কিংবা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা।
৬. নারকেলের ফালি ও নারকেলের পানি:
নারকেলের ফালি কিংবা নারকেলের পানি আপনার বিড়ালের হজমশক্তির সমস্যা করতে পারে। তবে নারকেলের ফালি ও নারকেলের পানি যদি অল্প পরিমাণে খায় তাহলে তেমন সমস্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা নারকেলে উপস্থিত পটাসিয়ামের পরিমাণ খুব বেশি, যেটি কিছু বিড়ালের ত্বকের সমস্যার জন্য অনেক কার্যকরী একটি উপাদান। কিন্তু বিড়ালের খাদ্যতালিকায় নারকেল অন্তর্ভুক্ত করার আগে অবশ্যই আপনার পশুচিকিৎসকের সাথে কথা বলে তারপর অন্তর্ভুক্ত করবেন।
৭. দুগ্ধজাত দ্রব্য:
বিড়ালকে দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়ালে তার হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেহেতু অনেক বিড়ালেরই দুধে থাকা ল্যাকটোজ হজমে শোষিত করতে পারে না। তাই আপনার উচিত হবে সম্পূর্ণভাবে দুগ্ধজাত দ্রব্যগুলি (দুধ, পনির, দই) এড়িয়ে যাওয়া। তবে এক্ষেত্রে আপনি আগে আপনার পশুচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন।
৮. আঙ্গুর ও কিশমিশ:
যদিও আঙ্গুর ও কিসমিশ বিড়ালদের জন্য বিষাক্ত কিনা এই সঠিক উত্তরটি এখনো অজানা, তবে বিভিন্ন গভেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, আঙ্গুর এবং কিশমিশে থাকা উপাদান বিড়াল ও কুকুরের কিডনি বিকলে সহায়ক।
৯. বাদাম:
ম্যাকাডামিয়া বাদাম আঙ্গুরের মতোই বিড়ালদের জন্য বিষাক্ত, যদিও বিষাক্ততার সঠিক প্রক্রিয়াটি এখনো অজানা। সাধারণত বাদাম, পেকান এবং আখরোটসহ অন্যান্য বাদামগুলিতে প্রচুর পরিমাণে তেল ও চর্বি থাকে যা বিড়ালের হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং এমনকি বিড়ালের প্যানক্রিয়াটাইটিসের মতো জটিল রোগও সৃষ্টি করতে পারে।
১০. কাঁচা ডিম:
কাঁচা ডিমে সাধারণত সালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে যার ফলে কাঁচা ডিম খেলে বিড়ালের মাঝে যে লক্ষণগুলির আবির্ভাব হয় তার মধ্যে রযেছে- বমি, ডায়রিয়া ও জ্বর। এছাড়া কাঁচা ডিমে অ্যাভিডিন নামক একটি এনজাইম থাকে যা বিড়ালদের বায়োটিন শোষণে বাধা দেয়। বায়োটিন হলো একটি ভিটামিন বিড়ালের ত্বক ও পশমের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
১১. কাঁচা কিংবা কম সিদ্ধ মাংস:
কাঁচা ডিমের মতোই কাঁচা কিংবা কম রান্না করা মাংসে সালমোনেলা এবং ই. কোলাই নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর। প্রাণী পুষ্টিসবা অধিদপ্তরের মতে, সালমোনেলা এবং ই. কোলাই নামক ব্যাকটেরিয়া বিড়ালদের মধ্যে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল(সাধারণত ডায়রিয়া) এর মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
১২. কাঁচা মাছ:
কাঁচা মাংস কিংবা ডিমের মতো কাঁচা মাছে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া থাকে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
১৩. লবণ:
লবণ ও নোনতা খাবার প্রচুর পরিমাণে খেলে আপনার বিড়ালের মধ্যে ডায়রিয়া, কাঁপুনি, খিঁচুনি লক্ষণসহ মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
১৪. কিছু শাকসবজি এবং ভেষজ:
যদিও বিড়ালরা অনেক শাকসবজিই খেতে পারে তবে কিছু শাকসবজি যেমন- পেঁয়াজ, রসুন, লিকস, স্ক্যালিয়ন ও শ্যালটসের মতো শাকসবজিগুলো বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর খাবার। এগুলো যা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনালের সমস্যাসহ বিড়ালের রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। তাই এই সবজি এবং ভেষজ ধারণকারী খাবার যেমন- গার্লিক ব্রেড পাশাপাশি সব খাবারই এড়ানো উচিত।
১৫. জাইলিটল:
জাইলিটল বা Xylitol হল আঠা কিংবা ক্যান্ডির মতো প্যাকেজকৃত পণ্যের এক প্রকার মিষ্টিদায়ক উপকরণ যা আপনার বিড়ালের মধ্যে বমি, অলসতাসহ কিডনি বিকলের কারণও হতে পারে।